নিয়মিত ভাত খাওয়া কি স্বাস্থ্যকর

আমরা হলাম ভাত প্রিয় মানুষ। আমাদের বলা হয় মাছে-ভাতে বাঙালি বাঙালী। আমাদের ভাত একটি অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ খাবার। কিন্তু নিয়মিত ভাত খাওয়া কি স্বাস্থ্যকর হবে, ভাতের মধ্যে কি কি উপাদান থাকে এবং এবিষয়ে পুষ্টিবিদরা কী বলেছেন? আমাদের জন্য এগুলি জানা অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ। আজকে আমরা এই প্রবন্ধে ভাত নিয়ে ৭টি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নিয়ে আলোচনা করবো।

ভাত কী?

চালকে জলে সেদ্ধ করার মাধ্যমে ভাত রান্না করা হয়ে থাকে। বিশ্বের অনেক মানুষের জন্য ভাত একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রধান খাদ্য। তবে  বাংলাদেশ এবং ভারতে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের জন্য ভাত প্রধান খাদ্য প্রধান খাদ্য হিসাবে বেবাচিত করা হয়। বাংলাদেশ এবং ভারত ছাড়াও জাপান, চীন ও কোরিয়ায় প্রচলন রয়েছে ভাত খাওয়ার।

নিয়মিত ভাত খাওয়া কি স্বাস্থ্যকর
ভাত কিভাবে তৈরি করে হয়

তবে সব দেশের মানুষ এক রকম ভাবে ভাত রান্না করেনা। স্থান ভেদে বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভাবে ভ্যাট রান্না করে এবং তাদের ভাত খাবার ধরনও আলাদা। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ ভারতে বেশির ভাগ ভাত ঝরঝরে খাওয়া হয়। কিন্তু অন্যান্য দেশ যেমন কোরিয়ায়, চীন, জাপান আঠালো যুক্ত ভাত খেতে বেশি পছন্দ করে.

চাল থেকে ভাত

ভাত এক ধরনের শস্যজাতীয় খাবার যা শর্করার বা কার্বোহাইড্রেট এর প্রধান উৎস। বিশ্বের প্রায় অর্ধেক মানুষ কার্বোহাইড্রেটের চাহিদা মেটানোর জন্য ভাত খাই। সাদা চালে শস্যের ওপরে থাকা পুষ্টি সমৃদ্ধ আঁশের আবরণ তুলে ফেলা হয়। এতে চাল অনেকদিন পর্যন্ত দিন টেকে,রান্না হয় দ্রুত এবং সহজপাচ্য।

কেরি টরেনস
বিবিসিগুড ফুডের পুষ্টিবিদ
পুষ্টিকণার দিক থেকে হিসাব করলে সাদা চালে তুলনামূলকভাবে ফাইবার এবং প্রোটিন কম থাকে। অনন্য দিকে বাদামী চালে আঁশের আবারণ থাকায় এটি তুলনামূলকভাবে অধিক পুষ্টিকর ও সুস্বাদু হয়।

ভাতের মধ্যে কি কি উপাদান থাকে?

ভুঁড়ি, মেদ যতই বাড়ুক না কেন, যদি এক বেলা ভাত না খাওয়া হয় তবে মনে হয় সারা দিনটাই মাটি। পুষ্টিকর ভাতে প্রধানত শর্করা সরবরাহ করে। তবে পুষ্টিকর ভাতে কিছুটা আমিষের পরিমাণও পাওয়া যায়। স্নেহ ৬%, শর্করা ৭৯%, এছাড়াও ভিটামিন ও খনিজ লবণ পাওয়া যায়।

নিয়মিত ভাত খাওয়া কি স্বাস্থ্যকর
ভাতের মধ্যে কি কি উপাদান পাওয়া যায়

প্রতি ১০০ গ্রাম সেদ্ধ সাদা ভাতের পুষ্টিগুণ:

  • কিলোক্যারলি – ১৩১
  • ফাইবার – ০.৫ গ্রাম
  • ফ্যাট – ০.৪ গ্রাম
  • কার্বোহাইড্রেট – ৩১.১ গ্রাম
  • প্রোটিন – ২.৮ গ্রাম

বাদামী চাল বা ব্রাউন রাইস চালের ভাতের পুষ্টিগুণ

ধান থেকে খোসা ছাড়ানোর পরে যে চাল পাওয়া যায় সেই চালই মূলত ব্রাউন রাইস বা বাদামী চাল বলা হয়ে থাকে। সাদা চালের ভাতের চেয়ে পুষ্টিগুণে বাদামী চালের ভাত বেশি ভিটামিনে সমৃদ্ধ। যদি প্রতিদিন এক কাপ মত বাদামী চালের ভাত খাওয়া হয় তবে প্রায় ৬০% ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি থেকে এড়ানো সম্ভব।

নিয়মিত ভাত খাওয়া কি স্বাস্থ্যকর
ব্রাউন রাইস চালের ভাতের পুষ্টিগুণ

প্রতি ১০০ গ্রাম বাদামী চালের ভাতের পুষ্টিগুণ:

  • কিলোক্যারলি – ১৩২
  • ফাইবার – ১.৫ গ্রাম
  • ফসফরাস – ১২৫ মিলিগ্রাম
  • ফ্যাট – ০.৯ গ্রাম
  • কার্বোহাইড্রেট – ২৯.২ গ্রাম
  • প্রোটিন – ৩.৬ গ্রাম
  • ম্যাগনেশিয়াম – ৪৮ মিলিগ্রাম

নিয়মিত ভাত খাওয়া কী স্বাস্থকর?

নিয়মিত ভাত খাওয়া কী স্বাস্থ্যের জন্য ভালো? নিয়মিত ভাত খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ভালো হবে কি খারাপ হবে সেটা আপনার উপর নির্ভর করে। এই প্রশ্নের উত্তর এক কথায় দিতে হলে বলতে হবে সময় মতো ভাত খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ভালো হবে।  তবে যদি ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হাইপারলিপিডেমিয়া ইত্যাদির সমস্যা থাকলে নিয়মিত ভাত খাওয়া আপনার জন্য মোটেও স্বাস্থ্যকর হবে না।

আমাদের দেশ ভাত প্রধান দেশ। এদেশের মানুষের প্রধান খাবার হলো ভাত। আমাদের দেশের প্রায় প্রতিটি মানুষই তিন বেলা ভাত খেয়ে বেঁচে থাকে। তবে ভাত যদি বেশি পরিমানে খাওয়া হয় তবে আমাদের শরীরে বেশ কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই আমাদের অবশ্যই জানতে হবে নিয়মিত ভাত খাওয়া কী স্বাস্থকর।

নিয়মিত ভাত খাওয়া কি স্বাস্থ্যকর

ভাতে ক্যালোরি বেশি থাকে। ভাত আমাদের শরীরে চিনির মাত্রা অনেকটা বাড়িয়ে দেয়। আপনি যদি অতিরিক্ত ভাত খান তবে আপনার শরীরে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। যদি আপনার শরীরে ডায়াবেটিস থাকে তবে আপনার জন্য ভাত খাওয়া একেবারেই ঠিক হবে না।

  • ভাত খেলে ওজন বাড়তে পারে
  • গ্যাসের সমস্যা হতে পারে
  • পেট ভারী এবং ফোলা দেখায়
  • শরীর অলস হয়ে যায় এবং অলস্য বাড়ে
  • শরীরে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে
  • ভাতে ডাইজেসটিভ ফাইবার নেই
  • ভাত রক্তে সুগার লেভেল দ্রুত বাড়িয়ে দেয়
  • ১৫০ গ্রাম ভাতে ২০০ ‌ক‌্যালরি থাকে
  • পেটে চর্বি জমার অন্যতম কারণ

আরো পড়ুন:

ভাত নিয়ে ৭টি অবাক করা তথ্য

এ পর্যায়ে আমরা ভাত নিয়ে ৭ টি অবাক করা তথ্য নিয়ে আলোচনা করবো। এই তথ্যগুলো আপনাকে অবশ্যই জানা গুরুত্বপূর্ণ।

০১: ভাতের ভূমিকা ওজনের ক্ষেত্রে:

কোন কোন গবেষণায় দেখাগেছে সাদা ভাত মানুষের ওজন বাড়াতে ও পেটের চর্বি জমার জন্য একমাত্র কারণ হতে পারে। তবে কিছু গবেষণায় সাদা ভাতের সাথে এগুলোর কোনো সম্পৰ্ক পাওয়া যায়নি। নিয়মিত সাদা ভাত রক্তে কার্বোহাইড্রেটের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় বলে অনেকটা ধারণা করা হয়ে থাকে। এই কারণে ওজনও বাড়তে পারে।

অনন্য দিকে বাদামী চালের মধ্যে রয়েছে ফাইবার ও প্রোটিন। বাদামী চালের ভাতে থাকা কার্বোহাইড্রেট সাদা ভাতের চাইতে দ্রুত শক্তিতে রুপান্তারত হয়। এ সব কারণে জন্য রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ অনেকটা কমে যায় ও ইনসুলিনের মাত্রা স্বাভাবিক থাকে। এগুলি সবই শক্তি বাড়ায়, ক্ষুধা কমায় এবং ওজন ঠিক রাখতে সাহায্য করতে পারে বলে পুষ্টিবিদরা জানিয়েছেন।

০২: ডায়াবেটিস ও ভাত:

হারবার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় বলা হচ্ছে ,প্রতিদিন যদি সাদা ভাত খাওয়া হয় তবে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। যাদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আছে, তারা দিনের বেলায় দুই বার বাদামী ভাত খেতে পারবে।

অনন্য দিকে যাদের ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত, তাদের জন্য ভালো হবে ভাত না খাওয়া এক বেলার বেশি । কিন্তু সেটিও হতে হবে পরিমিত এবং বাদামী ভাত।

ভাত খাওয়ার পর পরই ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যাস করা যাবে না। কারণ ভাত থেকে যে গ্লুকোজ নিঃসরিত হয় তা আমাদের রক্তে দ্রুত মিশে যায়। তাই গুমাতে যাওয়ার অতন্ত্য ৩/৪ ঘন্টা আগে আগে ভাত খেতে হবে, এবং কয়েক মিনিট শারীরিক ব্যায়াম অথবা পরিশ্রম করা যেতে পারে। ব্যক্তির ওজন অনুযায়ী, ভাত খাওয়ার পরিমাণ নিধারণ করে থাকেন পুষ্টিবিদরা।

০৩: দীর্ঘস্থায়ী রোগ থেকে রক্ষা করে বাদামী চাল:

বাদামী চাল অনেক ধরণের দীর্ঘস্থায়ী রোগ থেকে রক্ষা করে। বাদামী চালে থাকা ফ্লেভোনয়েট অনেক কঠিন রোগ প্রতিরোধে অত্যান্ত গুরুত্ব পূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গবেষণায় দেখা গেছে হৃদরোগ, টাইপ ২ ডায়াবেটিস, এমনকি অগ্নাশয় গ্যাসটিক্স রোগ সহ অনেক ধরণের ক্যান্সারের ঝুঁকি এবং শরীরের ওজন কমাতে সাহায্য করে ।

০৪: শক্তি সংরক্ষণ ও সাদা ভাত:

অনেক এথলেটিক তাদের শক্তি বাড়ানোর উৎস হিসেবে বিশেষ করে কায়িক ব্যায়ামের পর তারা সাদা ভাতকে বেছে নেই। কারণ সাদা ভাতে ভিতরে পরিশোধিত কার্বোহাইড্রেট বেশি থাকে, যা শারীরিক শ্রমের পরে মাংসপেশীর গ্লাইকোজেনের মাত্রা খুব দ্রুত পুনরুদ্বারের জন্য সাহায্য করে।

০৫: সাদা ভাত সহজপাচ্য:

সাদা ভাত অতি সহজে হজম হয়ে যাই এবং যদি সঠিক ভাবে রান্না করে খাওয়া হয় তবে গ্যাস্টিকের কোনো আশঙ্খা থাকে না। যারা বুকে জ্বালাপোড়া বা হালকা বমি বমি হয়, বিশেষ করে পরিপাকতন্তের জটিল রোগে ভুগছেন, তাদের জন্য সাদা ভাত খাওয়া বেশি উপকারী।

০৬: একটি গ্লুটেন – মুক্ত শস্য:

বিবিসি গুডফুডের একটি প্রতিবেদন বলেছে ভাত প্রাকৃতিকভাবে গ্লুটেনমুক্ত হওয়ায় যারা পরিপাকতন্তের সমস্যায় ভুগছেন বিশেষ করে তাদের জন্য এটি ভালো বিকল্প । বিশেষ করে বাদামী ভাতে অদ্রবণীয় প্রচুর ফাইবার রয়েছে, যা আমাদের হজমে জন্য সাহায্য করে এবং অন্ত্রের উপকারী হিসাবে ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বাড়াতে থাকে।

০৭: ভাত ও আর্সেনিক দূষণ:

যদিও খাদ্য তালিকায় ভাত গুরুত্বপূর্ণ। তবুও অনেক গবেষণা করে দেখা গেছে ভাত থেকে আর্সেনিক দূষণে আক্রান্ত হতে পারে। বাদামী চালের আবরণে এই আর্সেনিক এর পরিমান বেশি থাকে। এছাড়াও আর্সেনিকের প্রভাবে ক্যান্সার এবং হৃদরোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। শিশুরা থাকে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে। তবে আর্সেনিকের এই ঝুঁকি অনেকটা কাটানো সম্ভব হবে যদি রান্নার করার আগে ভালো ভাবে ধুয়ে নেয়া যায় এবং বেশি পানিতে সেদ্ধ নেয়া যায়।

এ ছাড়া অনেক পুষ্টিবিদরা মনে করেন দৈনিক আপনার খাদ্য তালিকায় পরিমিত ভাতের খাবার পাশাপাশি অন্যান্য যে সব সুষম খাবার আছে সে গুলো যদি খাওয়া হয় তবে সেটা অনেক উপকারেই আসবে।

উপসংহার

আশা করি আপনি বুঝতে পেরেছেন এই বিষয়ে নিয়মিত ভাত খাওয়া কি স্বাস্থ্যকর এবং ভাতের মধ্যে কি কি উপাদান পাওয়া যায়। আপনার বুঝতে যদি কোনো সমস্যা হয় বা আপনার আরো যদি কিছু জানার থাকে তবে অবশ্যই কমেন্ট বক্সে জানাতে ভুলবেন না। ধন্যবাদ পোস্টটি পড়ার জন্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *